শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন
বিশ্বসভ্যতা আজ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রবাহের অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে পৌঁছেছে। মানবজীবন এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গতিশীল ও সম্ভাবনাময়। আধুনিক এ সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা, ভোগবাদ ও প্রতিযোগিতা জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু এতসব অগ্রগতির পেছনেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক গভীর সংকট—নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতা এবং মূল্যবোধের অধঃপতন। ফলে প্রযুক্তির উন্নতি যতই বিস্ময় জাগাক, মানবিকতার ঘাটতি ততই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আধুনিক সমাজব্যবস্থা মূলত মানবকেন্দ্রিক দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে বস্তুই অগ্রগতির মাপকাঠি। অপরদিকে ইসলাম মানুষের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় চাহিদার সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক—সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়।
ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ইকবাল একবার বলেছিলেন, ‘যখন মানবজাতি প্রযুক্তির উন্নতিতে ডুবে যায় কিন্তু তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে, তখন সভ্যতা বাহ্যিকভাবে সমৃদ্ধ হলেও অন্তরে শূন্য হয়ে পড়ে।‘ আজকের পৃথিবী ঠিক সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে। প্রযুক্তি আমাদের সংযুক্ত করেছে, কিন্তু মানবিক বন্ধনকে দুর্বল করেছে। সমাজে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, কিন্তু সহানুভূতি কমেছে। পরিবারগুলো ভোগবাদী সংস্কৃতির চাপে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ইসলাম মানুষকে শুধুমাত্র শরীর ও ভোগের প্রাণী হিসেবে নয়, বরং আত্মিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে। ইসলাম এমন এক সমাজব্যবস্থার কথা বলে, যেখানে অর্থনীতি লাভের ওপর নয়, ন্যায়ের ওপর দাঁড়িয়ে; যেখানে রাজনীতি ক্ষমতার নয়, দায়িত্বের প্রতীক; যেখানে পরিবার কেবল সামাজিক কাঠামো নয় বরং মানবিক শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান।
আধুনিক সমাজব্যবস্থা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সর্বাধিক মূল্য দেয়। তবে এই স্বাধীনতা অনেক সময় দায়িত্বহীনতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় পরিণত হয়। ইসলামও স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু তা সীমাবদ্ধ করে দেয় নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও পরের ক্ষতি না করার শর্তে। ইসলামের দৃষ্টিতে, স্বাধীনতা মানে নয় “যা খুশি তাই করা”; বরং তা এমন স্বাধীনতা যা সমাজে শান্তি ও মানবিক মর্যাদা রক্ষা করে। সমাজে অধিকার ও কর্তব্যের এই ভারসাম্যই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য।
আধুনিক সমাজের সঙ্গে ইসলামের এই ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ই এখন সময়ের দাবি। ইসলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপক্ষে নয়—বরং আল-কুরআনের প্রথম শব্দই “ইকরা” (পড়), যা জ্ঞানের অনুসন্ধানের আহ্বান। মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে আল-জাহরাভি, ইবনে সিনা, আল-বিরুনি কিংবা ইবনে রুশদের আবিষ্কার ও দর্শন আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ইসলাম তাই অগ্রগতি ও মানবতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে সক্ষম এক শক্তি।
তবে সমন্বয়ের অর্থ ইসলামী মূল্যবোধের সাথে আপস নয়। বরং আধুনিক সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো—যেমন শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসন ও গণমাধ্যমে ইসলামী নৈতিকতার সন্নিবেশ ঘটানোই প্রকৃত সমন্বয়। আধুনিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছে সুদভিত্তিক ও প্রতিযোগিতামূলক কাঠামোর ওপর। এর ফলে বৈষম্য বাড়ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে। ইসলাম এই বৈষম্যের মূলে আঘাত হানে। ইসলামী অর্থনীতি সুদকে নিষিদ্ধ করে, সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের ওপর জোর দেয় এবং যাকাত, সদকা, দান ও ইনফাকের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তার এক বাস্তব ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুদবিহীন অর্থনীতির এক আধুনিক রূপ দিয়েছে; কিংবা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো দেখিয়েছে, কিভাবে ইসলামিক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব।
আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতা প্রায়ই দলের স্বার্থের কেন্দ্রীভূত থাকে। ইসলাম রাজনীতিকে দায়িত্ব ও আমানত হিসেবে দেখে। শাসক জনগণের মালিক নয়, সেবক। ইসলামী শাসনব্যবস্থার মূলনীতি হলো পরামর্শ ও জবাবদিহিতা। মহানবী (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে রাষ্ট্র পরিচালনা হতো স্বচ্ছতা ও জনগণের মতামতের ভিত্তিতে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি মানবসভ্যতার বড় অর্জন। ইসলাম এ অগ্রগতির বিরোধিতা করে না; বরং জ্ঞান অর্জনকে ফরজ ঘোষণা করেছে। তবে ইসলাম জ্ঞানের ব্যবহারকে নৈতিকতার সীমায় আবদ্ধ রাখে—যাতে প্রযুক্তি মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়, ধ্বংসের অস্ত্র না হয়। আধুনিক বিশ্বের পরিবেশ সংকট, অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও প্রযুক্তি-নির্ভর বৈষম্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিজ্ঞানকে নৈতিকতার ছায়া ছাড়া নিরাপদ রাখা যায় না।
মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী বলেছিলেন, “ইসলাম কোনো যুগের বিপরীতে নয়; বরং প্রতিটি যুগকে সে নৈতিকতার আলোয় আলোকিত করতে চায়।” আজকের সমাজে ইসলামকে সে আলো হিসেবেই দেখা প্রয়োজন—যা আধুনিক অগ্রগতিকে অর্থবহ, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক করে তুলতে পারে।
অতএব, ইসলাম ও আধুনিক সমাজব্যবস্থার সমন্বয় মানে কোনো সংঘাত নয়, বরং এক ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান—যেখানে বিজ্ঞান ও নৈতিকতা, অগ্রগতি ও মানবতা, স্বাধীনতা ও দায়িত্ব—সব একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। এই সমন্বয়ই হতে পারে ভবিষ্যৎ সভ্যতার টেকসই ভিত্তি।